বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বরাবরই খবরদারি মূলক আচরণ করার চেষ্টা করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গেলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও এ ধরণের তৎপরতা অব্যাহত ছিলো তাদের। নির্বাচনের আগে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নাওয়া খাওয়া ভুলে ব্যস্ত ছিলেন অযাচিত দৌড়ঝাঁপে।
তবে নির্বাচনের আগে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ ডেকে বিএনপি জামায়াতের তাণ্ডবের পর শ্রীলঙ্কা হয়ে নিজ দেশ সফর করে এসে অনেকটাই চুপ হয়ে যান তিনি। এদিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে পরে দেশটি জানায়, সহিংসতা পর্যবেক্ষণের জন্য আসবেন তারা। সেই ধারাবাহিকতায় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট- এনডিআই ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট আরআরআই’র দুটি দল নির্বাচনের সময় এবং আগে পরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। গেলো রোববার প্রকাশ করে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন। সেখানে দাবি করে গেলো সাত জানুয়ারির নির্বাচনে গুণগতমান ক্ষুন্ন হয়েছে। আবার তারাই বলেছে, নির্বাচনের প্রচারণা সময় এবং নির্বাচনের দিন আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় শারিরীক ও অনলাইন সহিংসতা কম হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সহিংসতা না হওয়ার জন্য নির্বাচনের সংস্থা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রকে একক কৃতিত্ব দেয়নি তারা। নিরাপত্তায় নিয়োজিত সরকারি সংস্থাগুলোর বাড়তি নজরদারি থাকার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করলেও সেই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে ‘দেশব্যাপী কার্যকর প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতির’ কথা। অর্থাৎ নির্বাচন প্রভাবমুক্ত হয়েছে এটি বুঝলেও সরাসরি স্বীকার করতে দ্বিধা তাদের!
এই প্রেক্ষাপটে সোমবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি লেখেন- যুক্তরাষ্ট্রের মতে বাংলাদেশে যদি তাদের পাপেট সরকার ক্ষমতায় না আসে, কোনো নির্বাচনই ত্রুটিমুক্ত নয়!
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টার বক্তব্যকে বিশ্লেষকদের অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ মনেকরছে। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সরব হয় যুক্তরাষ্ট্র। এই সুযোগে বাংলাদেশের অন্যতম একটি বড় রাজনৈতিক দল দেশজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে। তারা ভোট বানচাল করতে যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমানুষের মনে ভীতি তৈরির চেষ্টা করে। তবে তাদের অপচেষ্টা বানচাল হয়ে যায় জনগণের ভোটে। এসবের পরেও প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়। এতে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। এ নিয়েও অসন্তোষ্ট জানায় যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূত হিসেবে বাংলাদেশে দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পর পিটার ডি হাস গত ১০ মার্চ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। তার শিরোনাম ছিল গণতন্ত্রের ব্যাপারে গভীরভাবে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র।
ওই উপ-সম্পাদকীয়তে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোঝানোর চেষ্টা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে এবং অন্যত্র গণতন্ত্র-প্রসারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্লেষকরা বলছেন, একজন রাষ্টদূত হয়ে পিটার হাসের এমন লেখা কূটনৈতিক নীতি বহির্ভূত।
আবার যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও গাজা ও পাকিস্তানের ব্যাপারে নিশ্চুপ। তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল গাজায় নির্বিচারে গণহত্যা চালালেও এ নিয়ে নীরব আমেরিকা। উল্টো জাতিসংঘে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবও ঠেকিয়ে দিচ্ছে তারা;। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র ইসরায়েল ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় হামলা শুরু করে। এ হামলায় এ পর্যন্ত ৩১ হাজারের বেশি বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও পুরুষ।
এদিকে পাকিস্তানের বিতর্কিত নির্বাচন নিয়েও নীরব পাকিস্তান। পিটিআই-এর কর্মীদের দমন-পীড়ন, ইমরানের জেল, এবং নির্বাচন নিয়ে ৩১ কংগ্রেস সদস্যের আপত্তির পরেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ভোট নিয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি। দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল পিটিআই নির্বাচনে বেশি আসন পেয়েও ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ইমরানের দলকে শুধু ক্ষমতার বাইরেই রাখা হয়নি। ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর পিটিআইর প্রতিবাদ ঠেকাতে তৎকালীন সরকার সব সীমা অতিক্রম করে দলটির হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় অনেককেই হত্যা করা হয় এবং তাদের নির্বাচনে প্রচারণাতেও বাধা দেওয়া হয়। এসব ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্রও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। সুতরাং এ দুটি বিষয় থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে দ্বিমুখী আচরণ করছে। আর যেখানে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে সেখানেই তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়টি সামনে আনছে। একটু পেছনে ফিরলে দেখা যায়, ২০০৬ সালে ভুয়া ভোটার তালিকা এবং চরম পক্ষপাতমূলক প্রশাসন দিয়ে একটি যেনতেনমূলক নির্বাচনের চেষ্টা করেছিলো বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। সে সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে তা সম্ভব না হলেও, দেশের মানুষের ওপর চেপে বসে অনির্বাচিত সরকার। আর সেই সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নেড়েছিলো তাদের বিশ্বস্ত ও পুরনো বন্ধুদের দিয়ে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কিংবা উপদেষ্টা হিসেবে অনেক শিখন্ডিকে তারা রেখেছিলো, যারা বরাবরই মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় তৎপর থাকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন দ্বিমুখী আচরণের পর যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের এমন ফেসবুক মন্তব্য যথার্থ।